মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান (এমএফএস) নগদে বড় ধরনের প্রশাসনিক পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মাত্র ছয় মাসের মাথায় আগের প্রশাসক মুহম্মদ বদিউজ্জামান দিদারকে সরিয়ে নতুন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চট্টগ্রাম অফিসের পরিচালক মো. মোতাছিম বিল্লাহকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান এক প্রেস ব্রিফিংয়ে নিশ্চিত করেছেন যে মোতাছিম বিল্লাহকে
এক বছরের জন্য এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে, বদিউজ্জামানকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে যুক্ত করা হয়েছে।
এই আকস্মিক পরিবর্তন নিয়ে ইতোমধ্যে নানা গুঞ্জন তৈরি হয়েছে। নগদের সাম্প্রতিক বিতর্ক, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)
অভিযান এবং অনিয়মের অভিযোগের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত এসেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
নগদের প্রশাসনিক পরিবর্তনের পটভূমি
২০২৪ সালের ২১ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক নগদের আগের পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে এবং মুহম্মদ বদিউজ্জামান দিদারকে
প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়। সেই সময় নগদের সাবেক সিইও তানভীর এ মিশুক এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের
সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও, পরবর্তীতে বদিউজ্জামান তার বিরুদ্ধে হুমকির অভিযোগ এনে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
নগদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং অনিয়মের অভিযোগ তখন থেকেই আলোচনায় ছিল, যা পরবর্তীতে আরও ঘনীভূত হয়
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত এবং সাম্প্রতিক মামলার ঘটনায়।
দুদকের অভিযান ও প্রশাসকের ওপর হামলা
১২ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নগদে অভিযানে যায়। অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে পরিচালিত এই অভিযানটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।
হামলার ঘটনা:
সেই একই দিনে নগদের তৎকালীন প্রশাসক মুহম্মদ বদিউজ্জামান দিদারের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।
এই হামলার বিস্তারিত তথ্য এখনও স্পষ্ট নয়, তবে এটি দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
অনেকেই ধারণা করছেন, নগদের অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত শক্তির বিরোধের কারণেই এই হামলার ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
হামলার ১৫ দিনের মাথায় বদিউজ্জামানকে সরিয়ে নতুন প্রশাসক নিয়োগের ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
অর্থ আত্মসাতের মামলা ও নগদের বিরুদ্ধে অভিযোগ
নগদ লিমিটেডের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি মামলা করেছে। মামলায় নগদের সাবেক
চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল, সাবেক সিইও তানভীর আহমেদ মিশুকসহ মোট ২৪ জনকে আসামি করা হয়েছে।
অভিযোগের মূল বিষয়:
অতিরিক্ত ডিজিটাল মানি তৈরি:
বাংলাদেশ ব্যাংকের দাবি, নগদ অনুমোদিত সীমার বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত ৬৪৫ কোটি টাকার ইলেকট্রনিক মানি তৈরি করেছে।
এটি ব্যাংকিং নীতিমালার পরিপন্থী এবং আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অননুমোদিত লেনদেন ও আর্থিক অনিয়ম:
নগদের আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটির
আর্থিক কার্যক্রমের ওপর নজর রাখছিল এবং একাধিকবার সতর্কও করেছিল।
ডিজিটাল ব্যাংকিং নীতিমালা লঙ্ঘন:
নগদ ২০১৯ সালে মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) কোম্পানি হিসেবে যাত্রা শুরু করে এবং পরবর্তীতে ডিজিটাল
ব্যাংকের লাইসেন্স লাভ করে। তবে প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই বিভিন্ন নীতিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগের সম্মুখীন হয়।
নগদের বিতর্কিত যাত্রা: শুরু থেকেই অনিয়মের অভিযোগ
নগদ ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ মোবাইল আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে। তবে প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে।
🔸 ডাক বিভাগের সঙ্গে অংশীদারত্ব: নগদ প্রথম থেকেই ডাক বিভাগের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হয়ে আসছিল।
তবে এটি নিয়ে শুরু থেকেই আপত্তি ছিল, কারণ অন্যান্য এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি অনুমোদন নিতে হয়েছিল,
কিন্তু নগদ সেই নিয়মের আওতায় পড়েনি।
🔸 বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া এমএফএস পরিচালনা: নগদের কার্যক্রম নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে একাধিকবার মতবিরোধ হয়েছে।
🔸 গভর্নরের আপত্তি: বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর নগদের অনিয়ম নিয়ে কঠোর অবস্থান নেন এবং
প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
উচ্চ আদালতের রায়: বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত বৈধ
নগদে প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে আইনি বিতর্ক থাকলেও উচ্চ আদালত বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তকে বৈধ ঘোষণা করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন অনুযায়ী, কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম দেখা গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেখানে প্রশাসক নিয়োগ করতে পারে।
নগদের ক্ষেত্রে একই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং উচ্চ আদালত জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার আইনি অধিকার অনুসারে কাজ করেছে।
নতুন প্রশাসকের চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
নতুন প্রশাসক মো. মোতাছিম বিল্লাহর দায়িত্ব এখন অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হতে যাচ্ছে।
তার সামনে মূল চ্যালেঞ্জগুলো হলো:
নগদের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনা
অর্থ আত্মসাতের মামলার তদন্তে সহায়তা করা
বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে নগদের সুসম্পর্ক পুনঃস্থাপন করা
গ্রাহকদের আস্থার সংকট কাটানো
এই প্রশাসনিক পরিবর্তনের ফলে নগদের ভবিষ্যৎ কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হবে এবং প্রতিষ্ঠানটি কীভাবে অনিয়মের
অভিযোগ থেকে মুক্ত হতে পারবে, সেটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
নগদ কি আবারও স্থিতিশীলতা ফিরে পাবে?
বাংলাদেশ ব্যাংক কি আরও কঠোর পদক্ষেপ নেবে?
সব প্রশ্নের উত্তর সময়ই দেবে, তবে স্পষ্টতই, মোবাইল আর্থিক সেবার বাজারে নগদের অবস্থান এখন এক অনিশ্চিত পথে।