নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ: ইতিহাসের ধারাবাহিকতা নাকি নতুন রাজনীতির সূচনা?
নানা জল্পনা-কল্পনার পর একটি নতুন রাজনৈতিক দল আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং রক্তাক্ত এক বিপ্লবের পর এই দলটির গঠন নতুন আশা জাগিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই দল দেশের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারে এবং গ্রহণযোগ্য কর্মসূচির মাধ্যমে সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করবে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, তারা কি সত্যিই নতুন রাজনীতির সূচনা করবে, নাকি পুরোনো ধারাই অনুসরণ করবে?
কিছুটা বিলম্ব হলেও চলতি মাসের শেষ দিনে দলটির আত্মপ্রকাশ নিশ্চিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মতভেদ ও মতভিন্নতা স্বাভাবিক, তবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই দলটির আত্মপ্রকাশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি ও রাজনৈতিক শূন্যতা নতুন দলটির জন্য এক সম্ভাবনাময় সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সবসময়ই দুটি প্রধান দলের উপস্থিতি ছিল। ব্রিটিশ শাসনের সময় কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মুসলিম লীগের উত্থান ঘটেছিল। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর মুসলিম লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ) আবির্ভূত হয়।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে বাকশালের গঠন এবং ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর নতুনভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর পুনর্জাগরণ ঘটে। বিএনপি সেই সময় অন্যতম জনপ্রিয় দলে পরিণত হয়। বর্তমানে ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও একই রকম পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। নতুন দলটি সেই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি পূরণ করতে পারে কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
নতুন দলটি নিজেদের ‘নতুন বন্দোবস্তের’ প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তারা কতটা নতুন ধারা অনুসরণ করতে পারবে, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। অনেকেই বলছেন, এই দলটি মূলত সরকারের সুবিধাভোগী ‘কিংস পার্টি’। বিএনপির পক্ষ থেকে একাধিকবার এই অভিযোগ তোলা হয়েছে। তবে নতুন দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপিও রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালীন একইভাবে গঠিত হয়েছিল।
বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দলটি গঠন করেছিলেন, তবে সে সময় দেশে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল সক্রিয় ছিল না। অন্যদিকে, নতুন দলটি এমন সময়ে গঠিত হচ্ছে যখন অন্যান্য দল রাজনৈতিক মাঠে সক্রিয় রয়েছে। এই পরিস্থিতি ১৯৮০-এর দশকে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির আত্মপ্রকাশের সঙ্গে তুলনীয়।
নতুন দলটি নিজেদের মধ্যপন্থী দল হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইলেও তাদের রাজনৈতিক আচরণ অনেকাংশে ডানপন্থী দলগুলোর মতো। বিশেষত, একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গে তাদের অবস্থান অস্পষ্ট। দলে শিবির থেকে আসা কিছু নেতা-কর্মীর উপস্থিতির কারণে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করছেন যে, তারা ভবিষ্যতে ডানপন্থী রাজনীতির দিকে ঝুঁকতে পারেন।
নতুন দলটি দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে চাইলে একটি স্পষ্ট আদর্শিক ও দার্শনিক ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে। মুসলিম লীগ মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় রাজনীতি করেছে, আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করে রাজনীতি করেছে, বিএনপি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে রাজনীতি করে আসছে। কিন্তু নতুন দলের আদর্শ কী? তারা কি শুধুই একটি রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ করতে চায়, নাকি সত্যিকার অর্থে নতুন রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টি করতে চায়?
উপসংহার
নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তবে তাদের আদর্শ, নীতি এবং কৌশল সুস্পষ্ট না হলে তারা জাসদের মতো ক্ষণস্থায়ী হয়ে যেতে পারে। নতুন দলের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে জনসাধারণের আস্থা অর্জন করা এবং বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় টিকে থাকা। ভবিষ্যৎই বলে দেবে, তারা কি সত্যিকারের নতুন ধারার প্রতিনিধিত্ব করবে নাকি কেবল পুরোনো রাজনৈতিক কৌশলগুলোর পুনরাবৃত্তি করবে।